পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১২

ভয়

মাগরিবের আযান হচ্ছে। এখনো টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার দেওয়া হয়নি। জায়গির মালকিন হাঁস-মুরগি নিয়ে ব্যাস্ত। হাওরের সব রাখাল একে একে ছোট্ট আজমপুর গ্রামটা রেখে চলে যাচ্ছে নিজ নিজ গন্তব্যে। আজ কেন যেন অন্ধকারটা একটু আগেই নেমে এসেছে ঘন কালো হয়ে। বারান্দায় বসে আছে আনাস। অপোয় কখন জায়গির মালকিন টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার দিবেন। খাবার নিয়
ে যেতে হবে মাদ্রাসায়। নামাযটাও পড়া হচ্ছেনা এখনো। মসজিদটাও প্রায় আধা মাইল। এখন নামায পড়তে গেলে যাওয়ার পথে একটা লোকও পাওয়া যাবেনা। আর এই পথে একা যাওয়ার কথা ভাবতেই পারেনা আনাস! অপর দিকে মাদ্রাসায় আছে মাগরিবের পর রুমে ফেরার জন্য হল সুপারের জেরা। আনাস আরিক অর্থেই এখন ভয়ে সিটিয়ে যাচ্ছে! একে তো রাত প্রায় নেমে এসেছে। পথে গোরস্থান, ঈদগাহ্ পাড়ি দিয়ে একা মাদ্রাসায় ফেরা কোনতেই তার একার পে সম্ভব নয়। সে বুঝতে পারে না এই বাড়ির লোকগুলো কেন প্রতিদিনই সন্ধ্যায় খাবার দিতে দেড়ি করে? অথচ তারা নিজেরাও সন্ধ্যার পর এই পথে একা যেতে পারেনা। কিন্তু সে কিছুই বলতে পারেনা। তার ভাবনা একটাই; দুটো ভাত পাওয়া যায়। খাবারটাও ভাল। বোর্ডিংয়ের তুলনায় তো শাহী খাবার।

আবার হল সুপারের বিষয়টাও খুবই বিরক্তিকর! খাবার দেওয়াটা যেহেতু আনাসের এখতিয়ার না। সুতরাং একটু দেড়ি হতেই পারে। কিন্তু তিনি এই নিয়ে কত রকমের বাজে কথা যে বলবেন! “এত খাওন খাওন করস তো পড়তে আইসস কিলা? খালি খাইলে অইব? পড়াটা আগে খাওনটা পড়ে করলেও চলবে! এই সব খানা, লজিং বুঝিনা। মাগরেবের আগে মাদ্রাসায় ঢুকতে না পারলে শাস্তি পাইতে হবে!” এই উভয় সঙ্কট নিয়ে যখন আনাস ভাবনার ভয় নগরে। ঠিক তখনই জায়গির বাড়ির মুরুব্বি এসে বললেন “কি গো পলাশের মা মুন্সি বেডার খাওন দেও নাই?” আনাস কে অবাক করে দিয়ে পলাশের মা বললেন, “এইড কি মুন্সি গো বাবা! নমায যাইতাছে হেয় এখনো বইসা রইছে।” এই মুরুব্বীই আনাসের ভরসা সবসময়। এইবার সাহস নিয়ে আনাসের ভয় আর উভয় সঙ্কটের কথা মুরুব্বরি কাছে বলে। তিনি বলেন, ‘যাও কাইল থিকা আর দেড়ি হবেনা। মুরুব্বী তাকে একটু বুঝিয়ে বলায় পলাশের মা বলেন “আয় হায় কয় কিতা? মুন্সি মানুষ কত সুরা-কেরাত জানে হেরাও নাকি ডরায়! থাওক থাওক কাইল আর দেড়ি অইতনা।”

আনাস টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে রাস্তায় নামে। ঘুটঘুটে অন্ধকার! চারপাশে সুনসান নিরবতা। সব রাখাল হাওর ছেড়ে চলে গেছে। আর কাউকেই দেখা যাচ্ছেনা আশপাশে। আকাশে আবার কালো মেঘের আনাগোনা। হীম-শীতল বাতাসে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। এর সাথে যক্তি হলো আবার ভয়। আনাস এখন একটা সবকূল হারানো নাবিক যেন। কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারছেনা। সে কি আবার জায়গীর বাড়ি গিয়ে বলবে তাকে একটু এগিয়ে দিতে! নাকি দুয়া-দরূদ পড়ে একা একাই চলে যাবে! নাকি আর একটু অপো করবে দেড়ি করে ফেরা কোন রাখালের জন্য! এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে রাত ভাল করেই ঝেঁকে বসেছে আজমপুর গ্রামের ওপর। আবার ভাবছে এই গ্রামটা মূল গ্রামগুলো থেকে এত দূরে হাওরের পাড়ে কে বানাইছে? এখন তার সব রাগ গিয়ে পড়ল সেই লোকের ওপর। বানাইছে তো বানাইছেই আমার জায়গীরটাই এই গ্রামে কেন দিতে হবে। তার সব রাগ অভিমান এখন মাদ্রাসার বড় হুজুর আর তার বাবার দিকে যেতে লাগল। বড় হুজুর কেন এই দুর আজমপুর তার জন্য পছন্দ করল। আর বাবা! বোর্ডিংয়ে রাইখ্যা খাওয়ায় না কেন?

এইবার তার সব ভাবনার শেষ হয়ে এল। ভাবতে ভাবতেই আনাস বেশ খানিকটা পথ হেটে এসেছে। এখন আর ফিরে যাওয়ার কোন মানে হয় না। আর ফিরলেই লাভ কী ! শুনতে হবে কিছু হাসাহাসি! সব শেষে বলবে থাক আজ যাওয়ার দরকার নেই থাক। সকালে যাইবানে। সুতরাং নিজের জানা কয়েকটা দুয়া-দুরূদ পড়েই নিজের সাহসের উপর ভর করে হাটা দেয় আনাস।

এইবার আরেক উপদ্রব শুরু হয় আকাশে থেমে থেমে বজ্রপাত। ঠান্ডা বাতাস। কবর খনার ভয়! ঈদগাহে জমু পাগলার ডাক! এই পাগলা কিছুই করেনা তব্ওু তাকে আনাসের ভয়। বলা যায় জমু তাকে আদরই করে বেশি। যা সে আর কাউকে করেনা।

হাটছে হাটছে তো হাটছেই আনাস। কিন্তু পথ যেন শেষ হতেই চায়না। বিপদের সময় একটা আরেকটা বিড়ম্বনা। কথায় আছে বিপদের রাত শেষ হতে চায় না। মানুষের ভয়ের সময়টাতে নাকি দুনিয়ার সব ভয়ের কথা, ভয়ের ঘটনা, বিপদের আশংকা মনে এসে ভীড় করে! আনার্সেও হয়েছে সেই অবস্থা...

বেশ কদিন যাবৎ এলাকায় একটা গুজবের ডাল-পালা মেলে এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আনাস এটাকে গুজবই মনে করে এসছে। কিন্তু এখন কে যেন তার কানে ফিসফিস করে বলছে। আনাস সাবধানে যা! সড়কের দুই পাশেই ‘উজাউরির’ গাছ। উজাউরির গাছে আছে ভয়কর এক পোকা যদি কামড় দেয় আড়াই ঘন্টার মধ্যে মরণ নিশ্চিত! এই কথা সে আগ্ওে আনেক শুনেছে। শুনেছে রাজী গ্রামে দুইজন মারা গেছে। মদনে বহু মানুষ মারা গেছে। তবে সে কখনই মনে করেনি খবরটা সত্য। কারণ এই জাওয়ারেও অনেক উজাউরির গাছ আছে। কিন্তু এখনো এখানে কেউই তো এমন পোকার কোন হদিসই পায়নি! তাই এটা তার মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি। এখন সেই ভয়ও তার মনে প্রবল আতংকের সৃষ্টি করছে। থেকে থেকে পথের দুই পাশে তাকাচ্ছে এই বুঝি সেই পোকাটা তার বাহুতে এসে বসেছে! অজান্তেই হাত ঝেড়ে পোকাট ফেলে দিতে চচ্ছে । পরনেই আবার স্বাভাবিক হওয়ার জন্য। নিজের বোকামীতে নিজেই হেসে উঠছে। তবে নিজের হাসি নিজেকেই ভরসা দিচ্ছে না। আবার দুয়া-দুরূদ পড়ে নতুন করে পথ হেটে যাচ্ছে আনাস।

পথটা এখনো শেষ হচ্ছে না। আমাসের কাছে মনে হছে সে প্রায় এক ঘন্টা ধরে পথ হাটছে। অথচ আধা ঘন্টার পথ এখনো শেষ হচ্ছেনা। নিজের সাথে নিজেই কথা বলছে...
_ আমি কি কানাওলার পাল্লায় পড়ছি? নাহ্ আমি তো দুয়া পড়ছি কানাওয়ালা আমাকে ধরতে পারবেনা। কানাওয়ালা না ধরলে এখনো কেন মাদ্রাসায় যেতে পারছিনা! নাকি আমি পথ ভুল করেছি? নাহ তাও সম্ভব না। পথ তো একটাই! তাইলে আমি এখন কোতথায়? কল্পনায় শুনতে পায় কে যেন তাকে বলছে...
_আরে আনাস তুই পথও হারাসনি। কানাওলাও ধরেনি তোরে। তুই ঠিক পথেই আছিস আর একটু। মাত্র তো পাঁচ মিনিট হলো। এখনই ভয় পাওয়ার কী হইছে। যা হেটে যা এই তো গোরস্থানটা এটা পার হলেই আর কোন ভয় নেই।

মাত্র পাঁচ মিনিট! নাহ আমার মনে হয় কোথাও কোন সমস্যা হচ্ছে। তাইলে আমি কি অবচেতন জগতে চলে যাচ্ছি ক্রমশঃ ভয়টা আরোও বেড়ে যায় আনাসের। চার পশে আবার ভাল করে দেখে নিতে চায়। কিন্তু অন্ধকারে জন্য কিছুই দেখা যায়না। কয়েকটা জোনাকী আর ঝিঝিদের ডাক ছাড়া নিথর এই চার পাশ। এইবার আর বাধ দিতে পারেনা আনাস তার অনুভুতিকে। অজান্তেই চোখের পানি নামতে থাকে। এক সময় চিৎকার করে কাঁদতে চায়। আশ্চর্য! সে চিৎকার দিতে পারছেনা! কে যেন তার গলা ধরে আছে। পরনেই শুনতে পায় কে যেন খুব মিহিন সুরে বলছে, “চিৎকার করবিনা! বেশি কিছুনা আমরা তোরে একটু দেখবো তার পর আমার মাদ্রাসায় গিয়া দিয়া আসমু। মেলাদিন কোন যেতা মানুষ দেহিনা! মাইনষে আমগোরে ভয় পায়। একা একা এই পথে যায় না। তাই মানুষ দেখবার পারিনা। আজকা তোরে পাইছি। বড় হুজুরের কাছে একটা খবরও আছে। তুই একটু খাড়া।”

আনাস কিছু একটা বলতে যাবে। এমন সে নিজেকে শাসন করে “ আরে সব মনের কল্পনা! আনাস তুই এখন অনেক বড় হয়েছিস। এইটে পড়িস। এইটুকোতেই ভয় পাওয়া শুরু করলি?” আবার নিজেকে ধাতস্ত করতে মাথাটাকে ডানে-বামে মোছড় দেয়। চারপাশটা ভাল করে দেখে নেয়। সে দেখতে পায় কবর কানার মাঝামাঝি চলে এসছে। এইবার নিজের ভয়টাকে তাড়াতে একটা দৌড় দেয় আনাস। ভাবে এইতো একটু। তারপর আর কোন সমস্যা নেই। আনাস দৌড়াতে থাকে থাকে দৌড়াতেই থাকে। অবাক হয়ে ল্য করে সে যেখান থেকে দৌড় শুরু করেছিল সেই জায়গাটা থেকে একট্ওু এগিয়ে যেতে পারছেনা। মনে হয় হাজারো রশি দিয়ে তার হাত পা বাধা। শত চেষ্টা করেও সামনে যেতে পারছে না।

এবার তার মনে তীব্র ভয় এসে হানা দেয়। আনাস দেখতে পায় লাখে লাখে কঙ্কাল তার দিকে ছুটে আসছে। সব কঙ্কালের একটাই কথা তোরা জীবিত মানুস আমাদের ভয় পাস কেন? আমাদের কি কোন মতা আছে? আজকে শপথ করতে হবে আর কোন দিন মৃত মানুষকে বয় পাবিনা। যদি ভয় পাস তাইলে আজকে তোর একদিন আমগোর একদিন।
আনাস প্রাণপনে চেষ্টা করছে দৌড়ে পালাতে। অথবা একটা চিৎকার দিতে। অদূরেই আনাস দেখতে পাচ্ছে তার খোজে কয়েকজন ছাত্র হারিকেন নিয়ে আসছে । আনাস তাদের ডাকতে চাচ্ছে । কিন্তু সে কোন কথা বলতে পারছেনা। চারপাশ থেকে কঙ্কালগুলো তাকে ঘিরে ধরেছে। এইবার আনাস শেষ চেষ্টা হিসেবে আয়াতুল কুরসি পাঠ করতে থাকে। দেখতে পায় ওরা একটু সরে যাচ্ছে। আনাস তার খোঁজে আসা বন্ধুদের আর দেখতে পায়না। এখন সে ভাবছে এটাও মনে হয় তার মনের ভুল। আজ পুরো সন্ধ্যাটাই তার নানা ভুল ভাবনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পরণেই সে শুনতে পায় তার লজিং বাড়ির মুরুব্বীর গলা। শুনতে পায় তার বন্ধুদের গলা। কিন্তু সে ভেবে পায়না তারা তাকে কেন দেখতে পাচ্ছেনা! সুতরাং এটাও তার মনের দুর্মতি! এমনটা ভেবে দেখে সে আসলে রাস্তায় নেই। আছে ঈদগাহে। আবার চিৎকার করতে চায়! নাহ্ কঙ্কালদের ভয়ানক চিৎকার আর অট্টহাসিতে তার চিৎকার শুন্যে মিলিয়ে যায়। এবার আনাস আর কোন আশা দেখতে পায় না। শেষ চেষ্টা হিসেবে দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে এগিয়ে যেতে থাকে। দেখতে পায় সেই সব কঙ্কালের জঞ্জাল কিছুটা সরে যাচ্ছে। তবে এক দিকে সে যায় অপর দিক থেকে অন্যরা আসে তাকে আক্রমণ করতে। আনাসের আক্রমণাত্বক ভঙ্গি দেখে সব অশরীরীরাও আক্রমণাত্বক হয়ে ওঠে।
এবার আর কোন পথ না দেখে আনাসের নিজেকে নিয়তির উপর ছেগে দিতে ইচ্ছেে হয়। এমন সময় দেখতে পায় জমু পাগলা কোত্থেকে যেন খুবই খোশ মেজাজে সে উপস্থিত হয়। বলতে থাকে আয়হায় আমার জন্য এক খ্ওান কে আনছেরে। আনাস দেখে জমু ধরে ধরে এই সব কঙ্কাল খাওয়া শুরু করছে।

জমুকে দেখার পর আনাসের একটু সাহস আসছিল সেটাও এখন আর নেই। আনাস প্রাণ পণে একটা চিৎার দেয়। এর পর শুধু শুনতে পায় জমু বলতেছে... এইহান কেডারে ...

আনাস বস শুনতে পাচ্ছে কিন্তু কিছু বলতে পারছেনা। চোখটাও খোলার সাহস সে আর পাচ্ছেনা। সে দেখছে তার খোজে আসা সবাই তাকে ধরাধরি করে মাদ্রাসার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

পর দিন ফজরের নামাজের পর জানা গেল রাত ৮টার দিকে আনাসকে বেহুষ অবস্থায় কবর খানার পাশের রাস্তা থেকে বোর্ডিং সুপার আর আনাসের কয়েকজন বন্ধু উদ্ধার করে আনে। তারা আর আসতে দেড়ি হওয়ার খোজ করতে গিয়ে আনাস কে বেহুশ অবস্থায় পেয়েছিল।

আর জমু পাগলা! আজ চার দিন যাবৎ ডায়রিয়া হয়ে হাসপাতালে মরণপন্ন অবস্থায়।

বড় হুজুরের কাছে আনাস ও তার বন্ধুরা পুরো ঘটনার বিবরণ জানায়। আমরা সবাই অপোয় আনাসের জায়গীর নিয়ে বড় হুজুরের সিদ্ধান্তের ...

1 টি মন্তব্য: