পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১২

আট

অ্যানি ছুটল, এমির বাবার পাশ কাটিয়ে এক ছুটে চলে এল রাস্তায়, ভুলে গেল চাদর আর বিস্কুটের কথা, ভুলে গেল দিগি¦দিক, শুধু মনে একটাই চিন্তা যত দ্রুত সম্ভব বিলি উইলিয়ামসের কাছ থেকে পালাতে হবে।
জান বাজি রেখে দৌড়াচ্ছে অ্যানি, ছুটতে ছুটতে প্রচ-
হাঁপ ধরে গেল, দমের অভাবে বুক জ্বলছে আগুনের মত। অবশেষে ক্ষান্ত দিল ও, একটা গাছে হেলান দিয়ে হাঁপাতে লাগল, শরীর ভাঁজ হয়ে মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
ওর পা যেন নরম কাদা। শরীরের ওজন আর বইতে পারছে না। বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। চারপাশে তাকাল ও, কোথায় চলে এসেছে বোঝার চেষ্টা করছে। সবকিছু অচেনা ঠেকছে। ও রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে।
হঠাৎ পায়ের শব্দ শুনতে পেল অ্যানি, রাস্তার মাথা থেকে আসছে, একটা শরীর দেখতে পেল ও ক্ষণিকের জন্য। একটা ল্যাম্পপোস্টের আড়াল থেকে সাঁৎ করে বেরিয়ে পাশের একটি গাছের ছায়ায় চলে গেল।
‘কে ওখানে?’ কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল অ্যানি।
জবাব দিল না কেউ।
দীর্ঘস্থায়ী হলো নীরবতা, অ্যানির øায়ুতে প্রচ- চাপ সৃষ্টি করছে। ও সবে ভাবতে শুরু করেছে, যা দেখছে ভুল দেখছে, ঠিক তখন ঢিলা আলখাল্লা পরা একটি মূর্তি এসে দাঁড়াল রাস্তায়।
নিঃশ্বাস আটকে গেল অ্যানির।
ড্রাকুলা!
ঘুরল অ্যানি, দৌড় দেবে, প্রস্তর মূর্তি হয়ে থেমে গেল, যখন দেখল রাস্তার অপর মাথায় দাঁড়িয়ে আছে ড্রাকুলার আরেকটি প্রতিমূর্তি। ওকে ওরা ঘিরে ফেলেছে। তবে এবারে ভয় পাওয়ার বদলে স্বস্তি বোধ করল অ্যানি। ওকে আসলে কোন ভ্যাম্পায়ার ধাওয়া করেনি। ওরা সেই মহা পাজি যমজ ভাই।
দাঁড়াও, দাঁড়াও। কী যেন ভাবছিল ও? এমির অপার্থিব কণ্ঠ ওর মাথায় ভেসে বেড়াচ্ছে। ওদের ধারেকাছেও যেন যেয়ো না। ওরা খুব খারাপ।
নড়ে উঠল দুই ড্রাকুলা, মন্থরগতিতে এগিয়ে আসতে লাগল ওর দিকে।
ওদেরকে এগিয়ে আসতে দেখে বিদ্যুৎ খেলে গেল অ্যানির শরীরে। সে হাতের ধারের বাগানটির রাস্তা ধরে দৌড় দিল। একটা বাড়ি চোখে পড়ল ওর। ওই বাড়ির দরজায় দমাদম কিল মারতে লাগল, সেই সঙ্গে চিৎকার করছে, দরজা খুলে দিয়ে ওকে ভেতরে ঢুকতে দেয়ার জন্য।
অ্যানির বরাত মন্দ। যে বাড়িতে ও ঢুকতে চাইছিল, সেটা ডা. ব্রাউনের বাসা। তিনি মাত্র দশ মিনিট আগে দরজা-টরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেছেন। গেছেন অ্যানির গ্র্যানির পার্টিতে।
যখন বুঝতে পারল অ্যানি, কেউ তার কাতর আর্তিতে কান দেবে না, সে বাড়ির কিনার ঘেঁষে এগোল। এদিকে অনেকগুলো কার্ডবোর্ডের বাক্স পড়ে আছে। বাক্স সরিয়ে অন্ধের মত হাতড়ে পেছনের বাগানে চলে এল ও। বাগানটিকে বিভক্ত করে রেখেছে একটি বেড়া। বেড়ার ওপাশে আরেকটি বাগান, তারপর আরও একটি।
যমজ ভাইরা ওর পেছন পেছন দৌড়ে আসছে, টের পেল অ্যানি। ওদের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে ও। ভয়ে ওর পায়ে যেন পাখা গজাল। সে বাগান ধরে ছুট দিল। কুমড়োর ফ্লাওয়ার-বেড মাড়িয়ে ও ছুটছে। অবশেষে একটা ঝোঁপ পেরুতেই রাস্তায় এসে পড়ল অ্যানি, দৌড়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে আরেকটু হলেই এক মোটরসাইকেলের নিচে চাপা পড়তে যাচ্ছিল।
সশব্দে ব্রেক কষল চালক। শীতল নীল চোখে দেখল ছুটে যাওয়া অ্যানিকে।
অ্যানির পিছু নিয়ে আসছিল দুই যমজ ভাই, মোটর সাইকেলঅলার চোখে পড়ার আগেই ওরা তাকে দেখে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ছোটার গতি হ্রাস পেল দুই ভাইয়ের, প্রথমে জগিং-এর মত করে দৌড়াতে লাগল, তারপর হাঁটতে শুরু করল। যেন দুই নিষ্পাপ ভ্যাম্পায়ার ঘুরতে বেরিয়েছে, নিজেদেরকে ছাড়া দুনিয়াদারির অন্য কিছুই চেনে না।
বাইক চালক তাদের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মোটর সাইকেল নিয়ে ফিরে চলল খাবারের দোকানটিতে।
অ্যানি এদিকে ছুটতে ছুটতে ম্যাকডোনাল্ডের পাশের গলিতে ঢুকে পড়েছে, আবর্জনা রাখার একটা ড্রামের আড়ালে গুটিসুটি মেরে বসল। ঠা-া মাথায় চিন্তা করা দরকার। মূল রাস্তায় এমির বাবা ওর ওপর হামলা না-ও চালাতে পারে। তবু কোন ঝুঁকি নিতে চায় না অ্যানি। পকেটে পয়সা থাকলে কোন রেস্টুরেন্টে ঢুকে গ্র্যান্ডমাকে ফোন করে বলত, নাথান এসে যেন ওকে নিয়ে যায়। কিন্তু ওর কাছে কোন টাকা নেই। তাছাড়া ওর জামাকাপড়ও ছিঁড়ে গেছে, গায়ে ময়লা লেগেছে, এমন চেহারা নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলে লোকে কী বলবে? ওকে হয়তো ঢুকতেই দেবে না। করণীয় একটাই- থানায় যাওয়া। আর এ কাজটাই করতে ইচ্ছে করছে না ওর। কারণ থানায় গিয়ে যদি বলে, ও হারিয়ে গেছে, কথাটা খুবই হাস্যকর শোনাবে। কিন্তু এছাড়া তো উপায়ও নেই। তাহলে পুলিশ ওকে নিরাপদে পৌঁছে দেবে বাড়ি। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল অ্যানি।
ও সিধে হলো, বেরিয়ে এল গলি থেকে।
এবং সোজা গিয়ে পড়ল ড্রাকুলা ভ্রাতৃদ্বয়ের কবলে।

ঘড়ি দেখল শেরিফ। প্রায় দশটা বাজে। আর ঘণ্টা কয়েক বাদে সে মেবেলিনের সঙ্গে ড্রিংক করবে। সত্যিকারের মদ্য পান। কফি খেতে খেতে জিভ তেতো হয়ে গেল। পেটে হাত বুলাল সে। হজমেও কেমন গোলমাল হয়েছে।
আর কয়েক ঘণ্টা পরে সে রিল্যাক্সড হবে, আগামী আরেকটা বছরের জন্য নিশ্চিন্ত। এ মুহূর্তে সে ভাবছে সবকিছু ঠিকঠাক আছে, এমন সময় কিনা বাইকঅলা উদয় হলো!
মেবেলিন তাকে ফোন করেছিল। বলেছে, ঘণ্টাখানেক আগে সে নাকি বাইকঅলাকে দেখেছে। কিন্তু গত এক ঘণ্টায় কোন মোটরসাইকেল আরোহীকে চোখে পড়েনি শেরিফের। গেল কোথায় লোকটা? এভাবে স্রেফ গায়েব হয়ে যেতে পারে না নিশ্চয়ই। নাকি সত্যিই অদৃশ্য হয়ে গেছে?
আর অ্যানিই বা কোথায়?
শেরিফ কোনভাবেই চায় না, সেই ভয়ংকর রাতের পুনরাবৃত্তি হোক। তার গালের শুকনো ক্ষতটা চুলকাতে শুরু করল। সে কাটা জায়গাটা খচমচ করে চুলকাতে শুরু করল।

গলির পেছনে তাকাল অ্যানি। পালাবার রাস্তা খুঁজছে। নেই। এটা একটা কানাগলি। ফাঁদে পড়েছে ও।
শয়তানের চেহারা নিয়ে দুই যমজ ভাই ঘিরে ফেলল অ্যানিকে, ওকে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগল অন্ধকারের দিকে।
‘তোমার গ্র্যানি জানেন, যে তুমি রাস্তায় বেরিয়েছো?’ জিজ্ঞেস করল এক নম্বর ড্রাকুলা, ভৌতিক হেসে সূঁচালো দাঁত দেখিয়ে দিল।
‘তাতে তোমার কী?’ বলল অ্যানি।
‘ঝগড়া কোরো না’, বলল ড্রাকুলা দুই। ‘আমরা শুধু বন্ধু হতে চাইছি।’
‘এসো পরিচিত হই’, বলল প্রথম ড্রাকুলা। ‘আমি জো’, আলখাল্লাটির একটি আস্তিন নাটকীয় ভঙ্গিতে বুকের ওপর ঘুরিয়ে এনে কুর্নিশ করল।
‘আর আমি জ্যাকি’, বলল নাম্বার দুই, থাবা মারল অ্যানিকে লক্ষ্য করে।
চট করে একপাশে সরে গেল অ্যানি।
‘আমাকে তোমরা ছোঁবে না’, বলল ও। ‘শুনেছি তোমরা মানুষ ভালো নও।’
‘বদনামটা কে করল শুনি?’ শক্ত হাত দিয়ে অ্যানির গায়ে একটা খোঁচা মারল জো।
আবর্জনার ক্যানটির সঙ্গে বাড়ি খেল অ্যানি। কিছুক্ষণ আগে এখানেই লুকিয়ে ছিল সে। একটা হাত শরীরের পেছনে নিয়ে গেল, ক্যানের ঢাকনার নিচে অস্ত্র জাতীয় কিছু খুঁজছে। ধারাল কোণাসহ কোন পাত্র। ভাঙা কোন বোতল। এরকম কিছু একটা পেলেই হলো। তাহলে ওটা দিয়ে ওদেরকে ভয় দেখিয়ে পালাতে পারবে অ্যানি। কিন্তু হাতে কিছুই ঠেকল না।
‘এমি উইলিয়ামস বলেছে’, বলল অ্যানি। চোখের কোণা দিয়ে জ্যাকির বাম পায়ের কাছে একটা আধলা ইট চোখে পড়ল।
পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল যমজ ভাইয়েরা, তারপর তাকাল অ্যানির দিকে। ওদের চাহনির ধরণ মোটেই পছন্দ হলো না ওর।
‘কবে একথা বলেছে?’ জিজ্ঞেস করল জো।
‘কিছুক্ষণ আগে।’
‘মিথ্যুক!’ এক কদম আগে বাড়ল জ্যাকি, এমন জোরে চেপে ধরল অ্যানির কব্জি, রীতিমত ব্যথা পেল মেয়েটা।
‘ছাড়ো আমাকে’, গুঙিয়ে উঠল ও। ‘লাগছে!’
‘মিথ্যুক’, পুনরাবৃত্তি করল জ্যাকি, হাতটা মুচড়ে অ্যানির পিঠের কাছে নিয়ে এল।
‘ছাড়ো বলছি’, ধস্তাধস্তি করছে অ্যানি। ‘না ছাড়লে আমি কিন্তু চেঁচাব। তখন তোমদের কপালে ভোগান্তি আছে।’
কফিন-সাদা মুখটা অ্যানির মুখের কাছে নিয়ে এল জো। ওর নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ।
‘মিথ্যাবাদী, মিথ্যাবাদী, তুই কভু ছাড়া না পাবি’, সুর করে বলল সে।
‘আমি মিথ্যা বলছি না’, বলল অ্যানি। ‘ও বলেছে তোমরা খুব খারাপ। বলেছে, তোমরা বড়দেরকেও নাকি মানো না। তাদেরকেও বোকা বানাও। ও ঠিকই বলেছে, তোমরা খুবই পাজি।’
‘আমাদেরকে বোকা ভেবেছ, না?’ দাঁতমুখ খিঁচাল জ্যাকি। ‘মিথ্যাবাদী মুটি কোথাকার!’
‘খবরদার, আমাকে মিথ্যাবাদী মুটি বলবে না।’
‘একশ’বার বলব। কারণ, এমি উইলিয়ামস এখানে আর থাকে না।’ বলল জো।
‘গত বছর এ সময় ও অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল’, বলল তার ভাই।
‘নিখোঁজ।’ বলল জো।
‘সবার ধারণা সে মারা গেছে’, হিসিয়ে উঠল জ্যাকি।

নয়
‘আমার আর কিছু ভাল্লাগছে না’, হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে কিচেনে ঢুকলেন মার্থা জনস্টন। ‘দু’ঘণ্টা হয়ে গেল, অথচ এখনো মেয়েটার কোন খোঁজ নেই। শেরিফকে আবার ফোন করব।’
‘উচিত হবে না, মার্থা’, মিসেস জনস্টনের একটা হাত ধরল নাথান। ‘কোন খবর থাকলে উনি নিশ্চয়ই আমাদেরকে জানাবেন।’
‘তাহলে আমি নিজেই বাইরে গিয়ে ওকে খুঁজবো। এখানে বোকার মত আর বসে থাকবো না।’
‘কিন্তু তোমার অতিথিরা যে আসতে শুরু করেছেন’, বলল নাথান।
‘ওদেরকে তুমি ব্যস্ত রাখো। ওরা টেরও পাবে না, আমি বাসায় নেই।’
তিনি হন হন করে ঢুকলেন হলওয়েতে, কাঠের হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখা গ্রেট কোটটি খুলে নিতে মাত্র হাত বাড়িয়েছেন, ডোরবেলের তীক্ষè চিৎকারে চমকে গেলেন।
‘আমরা কি একটু তাড়াতাড়ি এসে পড়লাম?’ বললেন মরিন গ্র্যাডি, চোখের মণি দুই পুত্রধনের মত রোগা নন তিনি। বরং মোটাসোটা এবং ফর্সা। এক জার আচার নিয়ে এসেছেন মহিলা। জারটা বাড়িয়ে দিলেন নানির দিকে। মিসেস গ্র্যাডির পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর স্বামী শন। লাল চুলের পর্বত প্রমাণ মানুষটির হাতে বুশমিলস হুইস্কির বোতল।
‘মোটেই না’, পার্টির হাসি উপহার দিলেন মিসেস জনস্টন।
‘অনেকেই ইতিমধ্যে এসে পড়েছেন। যান, ভেতরে যান। নাথান আছে ঘরে। আমি একটু অ্যানির খোঁজে বেরুচ্ছিলাম। অতিথিদের সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।’
শন মিসেস জনস্টনকে হাত ধরে বাড়ির দিকে ঘুরিয়ে দিলেন মুখ।
‘ও যেমন আছে তেমন থাকতে দিন’, রায় ঘোষনার সুরে বললেন তিনি। ‘হ্যালোউইনের উৎসবে বড়দের নাক গলানো ঠিক না। যে বিষয়টি সম্পর্কে আপনি জানেন না, সে নিয়ে চিন্তা করে লাভ কী? ঠিক বললাম কিনা?’
‘ঠিক, ঠিক’, সায় দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন মিসেস গ্র্যাডি। ‘আমরা জো আর জ্যাকির কোন ব্যাপারে নাক গলাতে যাই না। আর ওরা তো পাড়া বেরিয়ে সহি-সালামতেই বাড়ি ফিরে আসে।’

অ্যানির হাত ছেড়ে দিল জ্যাকি, ভাইয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। জ্যাকি ওর দিকে পেছন ফেরা, এ সুযোগে সামনে ঝুঁকে চট করে মাটি থেকে ইটের টুকরোটা তুলে নিল অ্যানি। ইট তোলার সময় দু’টো শব্দ কানে এল ওর। ‘খেলা’ এবং ‘বাইক’।
হাতে অস্ত্র নিয়ে ঘুরল অ্যানি, কানাগলিটা আরেকবার দেখতে, সত্যি পালাবার কোন পথ আছে কিনা। ও ডরপুক নয়, তবে মারকুটে স্বভাবেরও নয়। ও সবসময় মারপিট এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে।
তবে এবারে ভাগ্য ওকে সহায়তা করছে না। কানাগলির পরে একটা দেয়াল সটান উঠে গেছে আকাশে। দেয়ালের পরে বিল্ডিং। ওদিক দিয়ে বেরুবার কোন রাস্তা নেই। কাজেই বেরুতে হবে দুই ড্রাকুলার বাধা অপসারণ করে।
ডানহাতে আধলা ইট নিয়ে ও লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হল। দুই ভাইয়ের উচ্চতা, ওজন, বয়স সবকিছুই অ্যানির চেয়ে বেশি তবে এ লড়াইয়ে জেতার একটাই অস্ত্র আছে- ওদেরকে ভড়কে দেয়া।
এবং সেটাই করতে যাচ্ছে অ্যানি।
ওরা যে মুহূর্তে ফিরল ওর দিকে, সঙ্গে সঙ্গে জো’র হাঁটুতে প্রচ- লাথি বসিয়ে দিল অ্যানি। আকস্মিক হামলার বিস্ময় এবং ব্যথায় চক্ষু রসগোল্লা হয়ে গেল জো’র। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে হাঁটু ভেঙে রাস্তায় পড়ে গেল সে।
একটা গেল। বাকি আছে আরেকজন।
এখন আশ্চর্য শান্ত হয়ে গেছে অ্যানি। একটুও ভয় লাগছে না ওর। জ্যাকির সোলার প্লেক্সাসে আধলাটা দিয়ে মোক্ষম একটা আঘাত করলেই ও অজ্ঞান হয়ে যাবে। সেই ফাঁকে ছুটে পালাবে অ্যানি।
পরিকল্পনা মাফিকই কাজ হতো। যদি না আকস্মিক পরিবর্তনটা ঘটত। মাত্র এক সেকেন্ডের মধ্যে সবকিছু কেমন ওলোট পালট হয়ে গেল।
গলিপথটা অদৃশ্য হয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। নিজেকে মাটিতে শুয়ে থাকা অবস্থ্ায় আবিস্কার করল অ্যানি, পচা পাতা মুখে লাগছে। এক যমজ, অ্যানি চেনে না কোনজন ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে রেখেছে। অপরজন চেপে ধরেছে পায়ের গোড়ালি। তাকে লাথি মারল অ্যানি, লাগল না। নিষ্ফল আক্রোশে ওর মুখ চেপে ধরা হাতটির নরম তালুতে সজোরে বসিয়ে দিল দাঁত। জ্যাকি, এখন তাকে চিনতে পেরেছে অ্যানি, চিৎকার করে ওর মুখ থেকে সরিয়ে নিল হাত। সঙ্গে সঙ্গে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার দিল অ্যানি।
‘ওর মুখ চেপে ধরো’, বলল জো। ‘নইলে শুনে ফেলবে কেউ।’
জ্যাকির হাত এবারে চেপে ধরল অ্যানির গলা, ধীরে ধীরে চাপ বাড়তে লাগল।
অ্যানি হাতের আধলাটা দিয়ে প্রচ- জোরে মারল জ্যাকির মাথায়। বাম ভুরুর ওপরে, কপালে লাগল ইট। দু’ভাগ হয়ে গেল ওখানকার চামড়া। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল রক্ত, রাস্তায় এলিয়ে পড়ল জ্যাকি।
লাফ মেরে খাড়া হলো অ্যানি, জো’কে ডজ দিয়ে এক ছুটে বেরিয়ে এল কানাগলি থেকে। উড়ে চলল রাস্তা দিয়ে। ওর বিপরীত দিক থেকে একটি পুলিশের গাড়ি আসছিল। ওটাকে বিদ্যুৎ গতিতে পাশ কাটাল সে। দু’মিনিট আগে হলেও পুলিশের গাড়ি দেখলে কৃতজ্ঞ চিত্তে গাড়ির দিকে ছুটে যেত সে, সাহায্য চাইত, কিন্তু এ মুহূর্তে ওর পলায়ন ছাড়া গতি নেই। শুনতে পেল পেছনে থেকে শেরিফ ওকে ডাকছে, থামতে বলছে। জ্যাকি গ্র্যাডিকে অত জোরে মারতে চায়নি অ্যানি। জানে খুব জোরে লেগেছে জ্যাকির। হয়তো এজন্য বড় ধরনের ঝামেলায় পড়ে যাবে সে।
তাই ও ডাক শুনেও থামল না। ছুটতেই লাগল।
তারপর পেভমেন্টে ওর পায়ের আওয়াজ ছাপিয়ে সেই শব্দটা শুনল ও, যে আওয়াজটা শোনার ভয় করছিল ও; জো গ্র্যাডির গলা, আইনের কর্মকর্তাকে চিৎকার করে বলছে- তার ভাইকে খুন করেছে অ্যানি।

কানাগলিতে ঢোকার পরে শেরিফের মনে হল সত্যি বুঝি মারা গেছে জ্যাকি। চিৎ হয়ে পড়ে আছে সে, মুখটা সাদা, মাথা দিয়ে দরদর করে রক্ত ঝরছে।
শেরিফ অজ্ঞান কিশোরটির পাশে হাঁটু মুড়ে বসল, ডান কানের নিচে হাত দিল পালসের জন্য। আছে। জ্যাকির পালস আছে। যদিও দুর্বল, তবু পালস টের পাওয়া যায়। ফোঁস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।
‘তোমরা এখানে কী করছিলে?’ জো’কে জিজ্ঞেস করল শেরিফ জোনাস।
‘আমরা মেয়েটাকে ম্যাপল স্ট্রিটে দেখতে পাই’, বলল জো। হাঁটুতে আঙুল ঘঁষছে। লাল হয়ে উঠতে শুরু করেছে ক্ষত।
‘আপনি ওর খোঁজ নিতে বলেছিলেন আমাদেরকে। তাই আমরা থামতে বলি।’
‘ওর সঙ্গে আর কেউ ছিল?’
‘না। ও একা ছিল। ছুটে পালাচ্ছিল। তাই আমরা ওর পিছু নিই। এখানে এসে ধরে ফেলি।’
‘তারপর কী হলো?’ নিজের ইউনিফর্ম জ্যাকেট খুলে জ্যাকির মাথায় বেঁধে দিল শেরিফ, রক্ত বন্ধ করতে।
‘তারপর ও আমার হাঁটুতে লাথি মারে আর জ্যাকির মাথা ফাটিয়ে দেয়।’
গাল লাল হয়ে গেল জো’র। ‘বোধহয় ও ভয় পেয়ে গিয়েছিল।’ বিড়বিড় করে বলল সে।
‘এজন্যই অমন জোরে চিৎকার করছিল?’
নাকি কান্না জুড়ে দিল জো। ‘আমি তার কী জানি? আমরা কিছু করিনি। আপনি আমাকে দোষ দিচ্ছেন কেন? জ্যাকিকে ও মেরে ফেলেছে।’
অজ্ঞান শরীরটা পাঁজাকোলা করে তুলে নিল শেরিফ।
‘গাড়ির দরজা খোলো’, হুকুম করল সে। ‘আর কান্নাকাটি বন্ধ করো। তোমার ভাই মরেনি। তবে ক্ষতস্থানে সেলাই লাগবে। ওকে এক্ষুনি ডা. ব্রাউনের কাছে নিয়ে যেতে হবে।’
জো শেরিফের হুকুম তামিল করল। শেরিফ তার যমজ ভাইকে পেট্রল বারের পেছনের আসনে বসিয়ে দিল। শরমিন্দা হয়ে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকল জো।
‘ভেতরে ঢোকো’, ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে বলল শেরিফ। ‘বাকি কথা পরে শুনবো।’

আবার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে অ্যানি। যেন দৌড়াবার জন্য দৌড়াচ্ছে। ওর দাঁড়িয়ে পড়া উচিত। রাস্তার হদিস জেনে ফিরে যাওয়া উচিত নানির কাছে। নানুর কাছে ও নিরাপদে থাকবে। নানু ওর কোন ক্ষতি হতে দেবেন না। মা ঘটনাটা শুনলে কী বলবে? ডনই বা কী বলবে? তারা কি ওকে রিফর্ম স্কুলে পাঠিয়ে দেবে? সারাজীবনের জন্য?
‘খোদা’, ছুটতে ছুটতেই প্রার্থনা করল অ্যানি। ‘জ্যাকি গ্র্যাডির যেন কিছু না হয়। ওকে তুমি সুস্থ করে দাও। ও যদি সুস্থ থাকে, শপথ করছি, জীবনেও আর এমন কাজ করব না।’
চোখের সামনে ফুটে উঠল কালো পানির রেখা। স্টিলওয়াটার লেক। যাক বাবা, অন্তত চেনা কিছু একটা তো চোখে পড়ল। নানির বাড়ি যাবার সময় এ লেকের পাশ দিয়ে গিয়েছিল ওরা। কিন্তু কতক্ষণ আগে? মনে হচ্ছে অনেক বছর। গাড়ির রুট ধরে যদি এগিয়ে যায় অ্যানি, নিশ্চয়ই একসময় বাড়ির রাস্তাটা চিনতে পারবে।
উন্মত্ত মায়া নেকড়ের ডাকের মত রাতের নৈঃশব্দ ফালাফালা করে দিল পুলিশের গাড়ির সাইরেন। আসছে এদিকেই। ভয়ানক চমকে উঠেছিল অ্যানি। এক লাফে লেকের ধারের কতগুলো ঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। পুলিশের গাড়ির ছাদের ওপরের ঘূর্ণায়মান বাতিটি দৃষ্টির বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত ওখানেই উবু হয়ে বসে রইল।
এক ঝলক বাতাসে ওর মুখের ওপর ঝাড়ের একটা ডাল এসে পড়ল। গালে পাতার বাড়ি খেয়ে মনে পড়ে গেল জ্যাকির ওকে গলা টিপে ধরার ভয়ংকর দৃশ্যটি।
এখন মাথা ঠা-া করে চিন্তা করা দরকার, এসব কী ঘটছে? ওরা এমি সম্পর্কে কী যেন বলেছিল? নিখোঁজ- সবার ধারণা মারা গেছে এমি। নিশ্চয়ই ঠাট্টা করেছিল ওরা। কিন্তু এ কীরকম বিশ্রী ঠাট্টা? ওরা আসলে অ্যানিকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল। ঠিকই বলেছিল এমি। যমজ ভাই দুটো ভয়ানক পাজি।
তবে এমিকেও ওর খুব অদ্ভুত মনে হয়েছে। ও আর ওর গা ছমছমে খেলাগুলো। অ্যানির আসলে এসবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়াই উচিত হয়নি। যতসব ফালতু খেলা।
‘ইটস ওকে’, ওর মনের কথা বুঝতে পেরেই যেন কানের কাছে ফিসফিস করল একটা কণ্ঠ, ‘তোমার যদি মন না চায়, আমরা আর ওই খেলাটা খেলব না।’
ঘুরল অ্যানি। ওর পাশে বসে আছে এমি, মাথাটা একদিকে কাত করে রাখা, তেরছা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, ঠোঁটে সেই অদ্ভুত, মুখ টেপা হাসি।

দশ
‘যমজদের বাবা-মা তোমার বাড়িতে?’ জিজ্ঞেস করল শেরিফ। দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসা হৈচৈ-এর কারণে গলা চড়াতে হচ্ছে তাকে।
‘কেন? হ্যাঁ, ওরা তো এখানে’, শেরিফের থমথমে চেহারা দেখে রক্তশূন্য হয়ে গেলেন মার্থা জনস্টন। ‘কোন সমস্যা হয়েছে?’ জোনাসের হাত চেপে ধরলেন। ‘ অ্যানিকে পেয়েছো?’
‘পেয়েছিলাম। বাম গালের শুকনো, হালকা ক্ষতচিহ্নে আঙুল ছোঁয়াল জোনাস। কুড়ি বছর আগে মেরী বেথ জনস্টন কাঁচি দিয়ে চিরে দিয়েছিল তার গাল। ‘সে দুই যমজ ভাইদের একজনকে ইট দিয়ে বাড়ি মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।’
বারান্দার সিঁড়িতে উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন মার্থা। ‘ঈশ্বর!’ বললেন তিনি। ‘কোথায় ও?’
‘আবার পালিয়েছে।’
‘হায়, জোনাস! তুমি ওকে পালাতে দিলে কেন?’
‘বাধা দিতে পারিনি। রক্তক্ষরণে মারা যাচ্ছিল জ্যাকি। ওকে ডাক্তার ব্রাউনের কাছে নিয়ে যাওয়ার খুব দরকার ছিল।’
‘ডা. ব্রাউন তো আমার বাড়িতে।’
‘আমি ওকে খবর দিয়েছিলাম। আমরা জো’কে নিয়ে হাসপাতালে যাই। জ্যাকিও এখন ওখানেই। অ্যানি মেরে ওর হাঁটুতে কালশিটে ফেলে দিয়েছে।’
হাত তুলে কপাল চাপড়ালেন মার্থা। ‘ইতিহাস সবকিছুর পুনরাবৃত্তি করে।’
‘একইভাবে নয়’, গম্ভীর শোনাল শেরিফের কন্ঠ। ‘কুড়ি বছর আগে ঘটনাটি ঘটেছিল বন্ধুদের মধ্যে। আজকের ঘটনাটি ভিন্ন।’
‘আর এক ইঞ্চি সামনে লাগলেই তোমার চোখটা ও গেলে দিত।’ মার্থার মন চলে গেছে সুদূর অতীতে।
শেরিফ তাঁর কনুই ধরে ফিরিয়ে আনল বাস্তবে।
‘আমার কৃতকর্মের ফল ছিল ওটা’, বলল সে। ‘দোষটা আমারই ছিল। বাবা আমাকে ধরে চাবকে ছিলেন, ডাক্তার মুখে কয়েকটা সেলাই করে দেয়। মেরীকে এক মাসের জন্য সবরকম সামাজিক অনুষ্ঠানে অনাহূত ঘোষণা করা হয়। পরে অবশ্য কেউ আর বিষয়টি নিয়ে কথা বলেনি। কিন্তু সেই সময়ের সঙ্গে এই সময়ের মেলা তফাত। আজকাল লোকে মামলা করে। শন গ্র্যাডি আমার বাবা নয়। ঝামেলায় পড়তে পারো, মার্থা। প্রস্তুত থেকো।’
মিসেস জনস্টন এক কদম সরে গিয়ে ধাক্কা মেরে দরজা খুললেন।
‘ভেতরে যাও, জোনাস। ওসব নিয়ে এখন চিন্তা কোরো না। আমি বরং নাথানকে গাড়ি নিয়ে পাঠাচ্ছি। দেখি ও অ্যানির কোন খোঁজ পায় কিনা।’

‘যমজ ভাইরা বলল, তুমি নাকি নিখোঁজ।’
‘ওরা অনেক কথাই বলে’, চুলে আঙুল বোলাচ্ছে এমি। ওর চুলগুলো সবসময়েই কেমন ভেজা ভেজা। ‘যা খুশি তাই করে। গুজব রটিয়েও ওরা পার পেয়ে যায়।’
অ্যানির একটা হাত বজ্রমুষ্ঠিতে চেপে ধরল সে। ‘তুমি ব্যাপারটা তাহলে জেনে গেছ, না?’
সিধে হল ও, অ্যানিকে খাড়া করিয়ে ওকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে এল ঝোপ থেকে, লেকের তীরে, অন্ধকার এক জায়গায় এসে দাঁড়াল।
‘এদিকে এসো’, বলল এমি। ‘তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।’
‘ওই সময় তুমি আমার মাথার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলে, তাই না?’ জিজ্ঞেস করল অ্যানি। ‘ছেলেদুটো নিশ্চয় তোমার কোন ক্ষতি করেছিল। ঠিক?’
নলখাগড়ার একটা ঝোপের ওপাশে, তীর ঘেঁষে একটা কাঠের গুঁড়ি ভাসছে, যেন ঘাপটি মেরে বসে আছে একটা কুমির।
‘জো এবং জ্যাকি লোককে জ্বালাতন করে মজা পায়’, বলল এমি। ‘এটা খুব খারাপ। ওরা সাইকো। তোমাকে আগেই সাবধান করেছিলাম।’
‘তুমি আমাকে সাবধান করোনি যে, ইয়ো-ইয়ো’র মত হুট করে আমার মগজে ঢুকে আবার বেরিয়ে যাবে।’ বলল অ্যানি। ‘এটাকেও আমি ভাল কাজ বলব না। স্বাভাবিক তো নয়ই। বরং অস্বাভাবিকই বলা যায়। তোমার কারণে খুব বাজে একটা অবস্থায় পড়তে হয়েছে আমাকে।’
‘দুঃখিত, আমি আর অমন করব না। তবে মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। ইটস আ গিফট।’
কাঠের গুঁড়ির সামনে হাঁটু মুড়ে বসল এমি, অ্যানিকেও বসতে ইশারা করল।
‘গিফট না ছাই’, বলল অ্যানি। ‘বরং বলো অভিশাপ। তোমার গিফটের কারণে ঝামেলায় পড়ে গেছি আমি। এমনই ভূতে পেয়েছিল আমাকে, জ্যাকি গ্র্যাডিকে ইট দিয়ে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছি। মরেই গেল কিনা কে জানে!’
‘ওদের মত শয়তান একটা ইটের বাড়িতে মরে না’, বলল এমি। ‘সে যাকগে, প্রয়োজন হলে আমি তোমার পক্ষ নেবো। এখন আমার একটা কাজ করে দাও।’
‘যদি না করি?’
‘আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। কঠিন কোন কাজ নয়। পানিতে আমার একটা জিনিস পড়ে গেছে। তুলতে পারছি না। তুমি তো আমার চেয়ে অনেক লম্বা। যদি তুমি...’
‘জিনিসটা কী?’
‘একটা লকেট। আমার মা আমার জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল।’

এগারো
কেসি উইললিয়ামস চুপচাপ বসে আছে আর্মচেয়ারে, উৎকর্ণ হয়ে। ওপর তলা থেকে কোন সাড়াশব্দ শোনা যায় কিনা। পুরোপুরি ঘুম হবার আগেই কোন কারণে বিলিকে সে জাগিয়ে দিলে, লোকটা তাকে চাবকে গায়ের ছাল ছাড়াবে। আজ অনেক মার খেয়েছে কেসি, আবার প্রহৃত হতে চায় না সে। বিলি যখন মাতাল হয় তখন তার সামনেই যাওয়া উচিত নয়। ও বাসায় ফেরার পরে কেসি এমিকে নিয়ে ঝগড়া না করলে, তার নাক ফাটাত না বিলি।
স্বামীর নাক ডাকানোর অপেক্ষায় বসে রইল কেসি। যখন বুঝল গভীর ঘুমে অচেতন বিলি, পা টিপে-টিপে বাথরুমে ঢুকল সে। অ্যাসপিরিন খেয়ে নাকের অসহ্য ব্যথা কমাবে।

অ্যানি বিস্ফারিত চোখে কাঠের গুঁড়ির গায়ে লেগে থাকা পিচ্ছিল, সবুজ, ঘিনঘিনে কাদার দিকে তাকিয়ে আছে। ওখান থেকে বুড়বুড় করে বিশ্রী গ্যাস বেরিয়ে ফেটে পড়ছে চারপাশে। শিউরে উঠল ও।
‘তুমি আমাকে ওখানে হাত দিতে বলছ?’
‘হ্যাঁ’, বলল এমি। ‘আমরা তো বন্ধু, তাই না? বন্ধুরা থাকেই একে অন্যকে সাহায্য করার জন্য।’
‘ঠিক আছে। আমার কাছে তোমার একটা সাহায্য পাওনা আছে।’ গভীর দম নিল অ্যানি। ‘একটা লকেট, তাই তো?’
‘গুঁড়ির নিচে ওটা আটকে আছে’, বলল এমি। ‘আমি লকেটটা হারাতে চাই না। ওতে আমার মায়ের ছবি আছে।’
প্রবল অনিচ্ছা নিয়ে জামার হাতা গোটাল অ্যানি, আঙুল চুবিয়ে দিল স্থির পানিতে। পানি থেকে পচা ডিমের গন্ধ আসছে, হাতটা তুলে আনল ও, ঝাঁকি মেরে ফোঁটাগুলো ঝেড়ে ফেলল। ‘থু!’ নাক কোঁচকাল অ্যানি। ‘কী বোঁটকা গন্ধ।’
‘কাজটা করে দাও, ভাই।’ অনুনয় করল এমি। ‘যত তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে পারবে, ততোই ভালো।’
‘ওখানে যদি কিছু থাকে?’
‘কী থাকবে!’
‘আমি কী জানি! পোকামাকড়। সাপ। ভয়ঙ্কর কিছু।’
‘তোমার পা ধরতে হবে আমাকে?’ দাঁতে দাঁত ঘষল এমি। ‘খুব জরুরি না হলে কাজটা তোমাকে আমি করতে বলতাম না।’
ছোট্ট, ফ্যাকাসে, অনুনয়ভরা মুখটির দিকে তাকাল অ্যানি।
‘তুমি যা জ্বালাতন করতে পারো!’ বলে থকথকে কাদার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিল সে। গুঁড়ির গায়ে হাতড়াচ্ছে, মনে হলো এক ব্যারেল কিলবিলে পোকার মধ্যে ঢুকে গেছে ওর হাত।

মেবেলিন লেভেভিয দোকান বন্ধ করার ইন্তেজাম করছে। হ্যালোউইন ডে’র কারণে আজ বেচাবিক্রি হয়নি তেমন। লোকে বাড়ি থেকে খুব একটা বেরোয়নি। আর যারা বেরিয়েছে, তারা গেছে পার্টিতে। মেবেলিনেরও দাওয়াত ছিল মার্থা জনস্টনের বাড়িতে। ও বাড়ির পার্টি এখনো চলছে কিনা, কে জানে! জোনাস কি মিসেস জনস্টনের নাতনিকে খুঁজে পেয়েছে, সেই বাইক চালককে কি ও ধরতে পেরেছে? ভাবছে, মেবেলিন নিজেই একবার গিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে আসবে কিনা? মার্থার হাতের তৈরি দুর্দান্ত শরবত পান করে আসবে এক গ্লাস? গেলেই হয়।
অকস্মাৎ দমকা হাওয়ায় দড়াম করে খুলে গেল দরজা। মেবেলিন, যে সহজে বিচলিত কিংবা চমকিত হয় না, লাফিয়ে উঠল দরজা খুলে যাবার শব্দে।
বোকার মত ভয় পাচ্ছি আমি, মনে মনে বলল মেবেলিন, তবু সবচেয়ে ধারালো এবং বড় কিচেন নাইফটা নিয়ে দরজাটা বন্ধ করতে গেল।
দরজার হাতলে হাত বাড়িয়েছে সে, দেখতে পেল, নির্জন পার্কিংলটে বুগারের মত হামাগুড়ি দিয়ে আছে হার্লি মোটর সাইকেলটা।
ঠিক তখন ভোজবাজির মত কালো গ্লাভস পরা একটা হাত চেপে ধরল ওর মুখ। মেবেলিনের হাত থেকে ছুরিটি মেঝেয় পড়ে গিয়ে শব্দ তুলল। তার পরপরই নিভে গেল সমস্ত বাতি।

‘এখানে কিচ্ছু নেই’, বলল অ্যানি। ‘একদম ফাঁকা।’
‘মনে হয় নিচের দিকে আছে’, বলল এমি। ‘আরেকটু নিচের দিকে খোঁজো।’
‘পেয়েছি’, গোল, মসৃণ একটা জিনিসের স্পর্শ পেয়েছে অ্যানির হাতের আঙুল। ‘কীসে যেন আটকে আছে।’ টান দিয়ে ওটাকে ছুটিয়ে আনার চেষ্টা করল। ‘গাছের ডাল-টালে বোধহয় আটকে গেছে। এখানে কিছু আগাছাও দেখতে পাচ্ছি।’
‘জোরে টান মারো’, পরামর্শ দিল এমি।
ঠা-ায় প্রায় জমে গেছে অ্যানির হাত। লকেটটা মুঠো থেকে পিছলে যেতে চাইছে। চেইনটা মুঠো পাকিয়ে ধরে ‘হেঁইয়ো’ বলে টান মারল ও। ছিন্ন হলো বাঁধা, লকেটসহ ওর হাত উঠে এল পানির ওপরে।
এতক্ষণ কতগুলো মেঘের পেছনে লুকিয়ে ছিল চাঁদ, ঠিক এই সময় আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সে। জোছনার রূপোলি আলোয় বিবর্ণ সোনার ঝিলিক দিল লকেট। মূর্তির মত জমে গেল অ্যানি। অন্ধকারে যেটাকে সে আগাছা ভেবেছে, তা আগাছা নয় আদৌ।
মেঘগুলো পর্দার মত আবার ঢেকে দিতে লাগল চাঁদ। আবার ঘনিয়ে এলো আঁধার। চিৎকার করে উঠল অ্যানি, পিছলে গেল পা এবং ছপাশ করে পড়ে গেল পানিতে।
কাঠের গুঁড়ের নিচে অতল গভীর হ্রদে ডুবে যেতে যেতে নল খাগড়া চেপে ধরার চেষ্টা করল অ্যানি। গুঁড়ির নিচে অন্ধকারে সাদা দাঁত বের করে হিহি করে হাসছে যেন ওটা। লকেট চেইনের টানে আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে নর কংকাল, খটখটে হাড়ের হাত বের করে যেন আলিঙ্গন করতে চাইল অ্যানিকে। তারের ফ্রেম, যেটা একসময় ব্যবহার করা হতো হেডব্যা- হিসেবে, চক্ষুহীন কোটরের সঙ্গে ওটা শক্তভাবে আটকে আছে। সাদা খুলির সঙ্গে এখনো জড়িয়ে আছে মলিন, বিবর্ণ কিছু চুল; ওগুলোকেই অন্ধকারে আগাছা ভেবেছিল অ্যানি।
ঈষৎ লোনা পানি ঢুকে গেছে অ্যানির মুখে, পা দিয়ে লাথি মারল ও, ওপরে ভেসে ওঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু পরনের জামা আটকে গেছে কোথাও, টেনেও ছাড়াতে পারছে না। উন্মাদের মত জামা খুলে ফেলার চেষ্টা করল অ্যানি। কিন্তু যত ধস্তাধস্তি করল, ততই ওগুলো ফাঁসের মত জড়িয়ে ধরল ওকে। পানির ওজনের চাপে পাতালে নেমে যাচ্ছে অ্যানি, পানিতে ভরে গেছে জুতো, পানি ঢুকছে কানে, নাকের ফুটোয় এবং ফুসফুসে। তারপর নিশ্চিদ্র এক আঁধার নামল। শুধুই অন্ধকার। তারপর আর কিছু মনে নেই অ্যানির।

1 টি মন্তব্য: